বিবরনঃ
ঝরণার যৌবন হলো বর্ষাকাল। বর্ষাকালে প্রচন্ড ব্যাপ্তিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে তা মিইয়ে মাত্র একটি ঝরণাধারায় এসে ঠেকে। ঝরণার ঝরে পড়া পানি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলেছে। এরকমই বিভিন্ন ছোট-বড় ছড়া পেরিয়ে জঙ্গলের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই ঝরণার কাছে পৌঁছতে হয়। ঝরণাটির কাছে যাওয়ার জন্য এখনও (নভেম্বর ২০১১) সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি, সাধারণত স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে কাউকে গাইড বা পথপ্রদর্শক নির্ধারণ করে পর্যটকরা ঝরণা ভ্রমণ করেন। তাছাড়া ঝরণাকে ঘিরে তৈরি হয়নি কোনো সরকারি অবকাঠামোও। ঝরণায় যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চম্পারায় চা বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা-বাগান থেকে ঝরণার দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পথে অত্যন্ত খাড়া মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক ঝিরিপথ ও ছড়ার কাদামাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। ঝিরিপথে কদাচিৎ চোরাবালুও তৈরি হয়, কিন্তু সেসকল স্থানে পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশিকা দেখা যায় না। এছাড়া গভীর জঙ্গলে বানর, সাপ, মশা এবং জোঁকের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়। বর্ষাকালে হাম হামে যাবার কিছু আগে পথে দেখা পাওয়া যায় আরেকটি অনুচ্চ ছোট ঝরণার। হাম হামের রয়েছে দুটো ধাপ, সর্বোচ্চ ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাঝখানের ধাপে, এবং সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের অগভীর খাদে। ঝরণার নিকটবর্তি বাসিন্দারা আদিবাসী ত্রিপুরা
কিভাবে যাবঃ
ঢাকার সায়েদাবাদ, কমলাপুর, কল্যাণপুর সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দিনে-রাতে বিভিন্ন পরিবহনের অসংখ্য বাস এই রুটে চলাচল করে। এই রুটে এসি ও নন-এসি দুই ধরনের বাসই রয়েছে। এসি বাসগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রীণ লাইন, আল-মোবারাকা সোহাগ, সৌদিয়া ও এস.আলম। আর নন-এসি বাসগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ পরিবহন, মামুন, ইউনিক পরিবহন।
রেলপথে
ঢাকা থেকে সরাসরি মৌলভীবাজারের সাথে রেল যোগাযোগ রয়েছে। ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলো মৌলভীবাজার হয়ে সিলেটে যায়। ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে প্রতিদিন একাধিক ট্রেন সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ঢাকা – সিলেট রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলো হলো-
কালনী এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস
বাস, ট্রেন বা বিমান যেভাবেই যান না কেনো, প্রথমে আপনাকে মৌলভীবাজার অথবা শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে যেতে হবে কমলগঞ্জ। শ্রীমঙ্গল থেকে লাউয়াছড়া যাওয়ার জন্য সিএনজি ও জীপ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ভানুগাছা বাসস্ট্যান্ড থেকে লাউয়াছড়া যাওয়ার লোকাল বাসও রয়েছে।
লাউয়াছড়া বনের গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, টিলা, কাঠের গুড়ি দিয়ে বানানো ছোট ছোট সাঁকো পেরিয়ে ঘন্টা খানিক হাটলেই পৌছে যাবেন কলাবানপাড়া। কমলগঞ্জ পৌরসভার মোড় থেকে আদমপুর রোড ধরে কলাবাগান পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুড়মা বাগান পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। কুড়মা বাগান থেকে কলাবাগান পর্যন্ত বাকি পথটা কাঁচা রাস্তা। যাওয়ার পথে রাস্তায় পড়বে প্রাচীন চম্পারায় চা বাগান। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চা শ্রমিকদের ছোট্ট একটি গ্রাম এই কলাবাগান । এখান থেকে একজন স্থানীয় লোককে গাইড হিসেবে নিয়ে নিতে হয়। দুর্গম হাম্মামের পথে এ ব্যক্তিই হবে আপনার পথ প্রদর্শক।
কমলগঞ্জ-আদমপুর বাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া পড়বে ১০ টাকা। সেখান থেকে ২০০ থেকে ২৫০টাকা ভাড়ায় সিএনজি যোগে আপনি অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারেন আদিবাসী বস্তি তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন বস্তি পর্যন্ত ।
কি খাবেনঃ
মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল শহরে আপনি খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্ট পাবেন তবে এসব হোটেল ও রেস্টুরেন্টের খাওয়ার মান নিয়ে বেশী আশা না করাই ভাল।
কোথায় থাকবেনঃ
শ্রীমঙ্গলে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। তবে হামহাম ঝর্না এলাকায় থাকার মতো তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। তবে নিজেকে যদি মানিয়ে নিতে পারেন তাহলে তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন আদিবাসী বস্তিতে আস্তানা গাড়তে পারেন। অথবা আদিবাসীদের ঘরেও থাকতে পারেন।
দেখার মত কি কি আছেঃ
প্রকৃতির অপরূপ লীলাভুমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় নতুন সন্ধান পাওয়া রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত একনজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠছে দিনে দিনে। দীর্ঘ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে অনেক কষ্টে গহীন অরন্যে এই জলপ্রপাতকে দেখতে প্রতিদিন আগমন ঘটছে দিনে দিনে পর্যটকদের ঢল।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহিন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ী এলাকার এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। স্থানীয় বাসিন্দারা একে হামহাম ঝর্না বা অনেকে হাম্মাম ঝর্না বলে ডাকে। এ জলপ্রপাতে যাবার কোনো রাস্তা না থাকলেও পর্যটকরা দূর্গম পাহাড় ও ছোট ছোট আকাবাকা এবং উচু উচু পাহাড় ডিংগিয়ে অনেক কষ্ট করে এখানে ছুটে যান প্রকৃতির নির্মল বিনোদন লাভের আশায়।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগের অভাবে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। এছাড়া প্রচার প্রচারনার অভাবেও বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাতটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলো।
পথের দু পাশের বুনো গাছের সজ্জা যে কোনো পর্যটকের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায় । চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর থেকে কানে ভেসে আসবে বিপন্ন বন মানুষের ডাক। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে আপনার দু’চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাটতে হাটতে একসময় পৌঁছে যাবেন আপনার কাঙ্খিত হামহাম জলপ্রপাতের খুব কাছাকাছি। কিছু দূর এগুলেই শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ।
চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তার এই অনন্য সৃষ্টির জন্য। জঙ্গলে উল্লুক, বানর আর হাজার পাখির ডাকাডাকির সাথে ঝর্নার ঝড়ে পড়ার শব্দ মিলে মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ক্ষনিকের জন্য ভূলেই যেতে হবে কোথায় আছি, কিভাবে আছি। উপরে আকাশ, চারিদিকে বন, পায়ের নিচে ঝিরির স্বচ্ছ জল আর সম্মুখে অপরূপ ঝর্না।
কমলগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩৮কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকায় এ জলপ্রপাতের অবস্থান। এ দর্শনীয় স্থানে যেতে হলে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল শহর থেকে স্থানীয় মিনিবাস, জীপ, মাইক্রোবাস ও সিএনজি নিয়ে কমলগঞ্জের-কুরমা চেকপোষ্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫কিঃ পাকা রাস্তা বাকী ১৫/২০ কিঃ মিঃ মাটির রাস্তায় পায়ে হেঁটে চাম্পা রায় চা বাগানের ভেতর দিয়ে কলাবন বস্তি হয়ে মোকামটিলায় গেলে দেখা পাওয়া যায় ১৫০ফুট উচ্চতা ও ৮০ ফুট প্রস্তের এই হাম্মাম জলপ্রপাত।